

মাহেলা–সাঙ্গাকারার ৬২৪ ও অন্যান্য
ক্যান্ডির সব ছেলেরা নাকি দস্যি হয়। মাহেলা জয়াবর্ধন অন্তত কুমার সাঙ্গাকারার সাথে দেখা হওয়ার আগে এটিই জানতেন। কিন্তু শ্রীলংকার বিখ্যাত স্কুল ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় তার সাথে যে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে, তাতেই সাঙ্গাকারা যে মোটেই দস্যি নয়, তা মাহিলা ভালভাবেই বুঝেছিলেন। উল্টো এই ছেলেটি ক্রিকেটের অতি মনোযোগী একজন অন্যতম শান্ত ছাত্র।
কৈশোর থেকেই শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ মনে করা হতো অনন্য প্রতিভাবান মাহেলা জয়াবর্ধনকে। তিনি অনূর্ধ্ব ২৪ ও ‘এ’ দলে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই খেলেছেন। সাঙ্গাকারার যখন আন্তর্জাতিক অভিষেকও হয়নি ততদিনে সেঞ্চুরি তো অবশ্যই, একটি ডাবল সেঞ্চুরি অবধি করে ফেলেছেন মাহেলা। তার কাঁধে তখন সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব।


“মাহেলার সহজাত প্রতিভার জন্য অন্যদের থেকে অনেক কম পরিশ্রমে ভালো ফল পেত সে। বড় ইনিংস খেলার দক্ষতা ছিল ওর অল্প বয়স থেকেই। ওকে ব্যাট হাতে দেখে হতাশ হতাম আমরা। বড় রান করার জন্য ওকে কখনোই আমাদের মত এত পরিশ্রম করতে হতো না।”
– সাঙ্গাকারা
পরিশ্রমী সাঙ্গাকারার, সাথে প্রতিভাবান মাহেলা। এ যেন ঠিক ‘opposites attack’ প্রবাদটির সফলতা। অন্যদিকে ড্রেসিংরুমে তাদের সমবয়সী কেও না থাকা টা তাদের বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তার অন্যতম কারণ হতে পারে।
আর এখন অবধি এই বন্ধু জুটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বাধিক রান প্রাপ্ত জুটি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ১৩,৩৬৮ তাদের যা অন্য যেকোনো জুটির থেকে বেশি। ২৯৩ বার জুটি বেঁধে তারা গড়ে প্রায় ৪৮ রান করেছে। জুটি বেঁধে হাফ সেঞ্চুরি করেছে ৬২ বার আর সেঞ্চুরি করেছে ৩৬ বার।
২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের জুটি বেঁধে ৬২৪ রান করা ছিল নিঃসন্দেহে তাদের একত্রে সবথেকে বিখ্যাত খেলা। শুধু টেস্ট ক্রিকেটে নয়, বরং প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যেকোনো উইকেটে এটি ছিল সব থেকে বড় জুটির রান।
সেই টেস্ট খেলায় দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক অ্যাশওয়েল প্রিন্স টস জিতে ব্যাটিং বেছে নেয়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম দিনেই গুটিয়ে ১৬৯ যায়। ফার্স্ট বোলার ডেল স্টেইন শ্রীলঙ্কার দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান কে ফিরিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, এ লড়াই সহজ হবে না। তবে তার পরের ঘটনা দু’দলের কোনো খেলোয়াড় কিংবা সিংহলিজ স্পোর্টিং ক্লাবের দর্শকেরাও ভাবতে পারেনি।
উপুল থারাঙ্গার চতুর্থ অভারে আউটের পর সাঙ্গাকারার সাথে ক্রিজে নামেন মাহেলা জয়াবর্ধন। রান যখন মাত্র ৭ তখন সাঙ্গাকারা ডেল স্টেইনের বলে স্লিপে ক্যাচ দেন। তবে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।
ঠিক পরের বলেই স্টে ইন বোল্ড করে সাঙ্গাকারাকে। দুর্ভাগ্যবশত বলটি ওভারস্টেপিংয়ের জন্য বাতিল হয়। আবারও বেঁচে যান সাঙ্গাকারা।
প্রথম দিনেই দুজনের ব্যক্তিগত রান ছিল অর্ধশতের বেশি। মাহেলার ৫৪ আর সাঙ্গাকারার ৫৫ রান।
তবে পরের দিন দক্ষিণ আফ্রিকাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে তারা দুজনেই করলেন ডাবল সেঞ্চুরি। ভালো রান রেটে দুজনে পরের দিন ম্যাচে যোগ করলেন ৩৫৭ রান। সাঙ্গাকারা প্রথমদিনের রানের সাথে করলেন ১৭০, মাহেলা করলেন ১৬৯।
ইতিহাস যেন তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে!
পরেরদিনও দুই সেশন তারা নিরাপদে কাটিয়ে দিলেন অদ্ভুত ব্যাপার এ সময় তারা ক্রিকেটের বাইরের কোথায় বেশি বলেছেন। তবে বিশ্ব রেকর্ড টা আস্তে আস্তে কাছে চলে আসছিল যখন, তখন একটু চিন্তিতই ছিলেন তারা।
তৃতীয় দিনের চা বিরতির আগেই এ জুটির তুলে ফেলেছিল ৫৭০ রান। আর মাত্র ৭ রান তারপরেই পেরিয়ে যাবেন ভারতের বিপক্ষে সনাথ জয়াসুরিয়া-রোশান মহানামার রেকর্ড রান ৫৭৬।
চা-বিরতির পর তারা ঢুকলো ইতিহাসের পাতায় এবং পরক্ষণেই গুল মোহাম্মদ ও বিজয় হাজারের ৫৭৭ রানের রেকর্ড তারা ভাঙলো।
কিন্তু এরপরই তাদের জুটি ভাঙলো অ্যান্ড্রু হল। সাঙ্গাকারাকে ব্যক্তিগত ২৮৭ রান নিয়ে ফেরত পাঠালেন তিনি। মাত্র ১৩ রানের জন্য সাঙ্গাকারার ট্রিপল সেঞ্চুরি হাতছাড়া হলো। তবে এটি ছিল টেস্ট ক্রিকেটে কার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর।
তবে এত বড় রান করেও না হতে পারলেন ম্যাচসেরা আর না হলেন দলীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কারণ মাহেলা থামেনি তখনও। একসময় সবাই মনে করছিল সে বোধ হয় ব্রায়ান লারার ৪০০ রানের রেকর্ড ও ভেঙ্গে ফেলবে।
কিন্তু তা হলোনা। ৩৭৪ রানে আন্দ্রে নেলের বলে বোল্ড হলেন তিনি। মাহেলার করা এই রান শ্রীলংকার হয়ে তার করা সর্বোচ্চ রান এবং ইতিহাসের চতুর্থ সর্বোচ্চ। অধিনায়ক হিসেবে করা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান তালিকায় আছে এটি।
এই ম্যাচে এ জুটি প্রায় ১৩ ঘণ্টা খেলে, যার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের তাদের জন্য বল করতে হয় ১৫৭ ওভার। এর পরে বা আগে কখনই এত লম্বা সময় ধরে কোন জুটি ব্যাটিং করেনি।


এক ইনিংসে এক জুটি প্রত্যেকে আড়াইশো রানের বেশি করেছিল এর আগে মাত্র একবার।
তবে ব্যাটিং এই সব রেকর্ড হয়নি। নিকি বোয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার স্পিনার ৬৫ ওভার বল করে রান দিয়েছে ২২১, কিন্তু একটি উইকেটও পাননি। এর আগে মাত্র একজন বোলারই এতো রান দিয়ে একটি উইকেটও পাননি।
দুজনে সব ম্যাচে একত্রে ব্যাটিং এ রান তুলেছে ৬৫৫৪, এ রানের ১০০ ভাগের ১০ ভাগই এসেছে এই এক ইনিংসেই।
তবুও এ কিংবদন্তি ক্রিকেটার রাখে করেছিল বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট জিততে না পারায়। তাদের সে আক্ষেপও ঘুচে যায় ২০১৪ সালে। তাদের এই বন্ধুত্ব শুধু ক্রিকেটের মাঠেই না, তার বাইরেও। ‘মিনিস্ট্রি অফ ক্র্যাব’ নামে একটি সামুদ্রিক খাবারের রেস্তোরাঁ খুলেছেন দুজনে মিলে। রেস্টুরেন্টের শাখা আছে মুম্বাইতেও। এছাড়া দুজনে বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠনেও অংশীদারি।
সাঙ্গাকারা অবসরের পর শ্রীলঙ্কা দলের নির্বাচক এর ভূমিকা পালন করছেন। বর্তমানে IPL এর রাজস্থান রয়্যালসের পরিচালক তিনি সাথে MCC এর সভাপতি। তিনি ধারাভাষ্যকতাও করেন মাঝে মাঝে।


মাহেলা এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি দল মুম্বাই ইন্ডিয়াতে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার মৃত ভাই ধীশালের স্মৃতিতে ‘Hope Censer Project’ ও ৭৫০ শয্যার ক্যান্সার হাসপাতাল পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।