

ময়ূর সিংহাসন : যে সিংহাসন সবচেয়ে দামী
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের এক অনন্য জায়গা তৈরি করেছেন সম্রাট শাহ জাহান, ইতিহাস যাকে মনে রাখবে তার তৈরি বিখ্যাত সব স্থাপত্য ও কীর্তির কারণে। স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশের উদ্দেশ্যে মমতাজের সমাধির উপর তার তৈরি তাজমহল হোক বা আগ্রার দুর্গ কিংবা দিল্লীর সুবিশাল জামে মসজিদ, সবকটিই তাকে অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের থেকে মানুষের কাছে আলাদা ভাবে পরিচয় করাতে সফল হয়েছে। বলা হয় যে, সম্রাট শাহ জাহানের আমলে স্থাপত্যবিদ্যা সবর্চ্চ সমৃদ্ধ ছিল আর তার প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা তিনিই করেছিলেন। তবে তার আর একটা মহাকীর্তি আছে, যা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা কমই হয়, সেটি ময়ূর সিংহাসন। আলোচনা কম হওয়ার কারণ হয়তো বা ভারতবর্ষে এর অনুপস্থিতি। তবে সম্রাট শাহ জাহানের আমলে নির্মিত অন্যান্য স্থাপত্যের চেয়ে এই সিংহাসনের গুরুত্ব কোনো দিক থেকেই কম না!


সম্রাট শাহ জাহান কেন অন্য যে কোনো প্রানীর বদলে সিংহাসনে ময়ূরই নির্মাণ করলেন, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। মুঘল সাম্রাজ্যের শিল্প- সাহিত্যে ময়ূরের যে বিশেষ গুরুত্ব ছিল, তা অন্য কোনো প্রানীর-ই ছিল না। মুঘল আমলে চিত্রকর্মে ময়ূরের আকৃতি অঙ্কন করা হতো সুনিপুণশীলতার সাথে। সেসময়ের সাহিত্যেও ময়ূরকে দান করা হয় এক আধ্যাত্মিক আবয়ব। এমনকি “শামস-ই-তাবাসি” নামের সে-আমলের এক কবি তার কাব্যে দাবি করেন যে, জান্নাতের সবচেয়ে উপরের স্তরে ময়ূর থাকবে। সেসময় এই প্রানীটিকে ধর্মীভাবে গুরুত্ব দেওয়ায়, সাধারণ মানুষদের ধারণা ছিল যদি ময়ূরের সম্মার্থে কিছু করা হয়, তবে হয়তো বা পরকালে তার কপালে ভাল কিছু জুটতে পারে।


তাই অনুমান করা হয় যে, এই বিশ্বাস থেকেই সম্রাট শাহ জাহান এ সিংহাসনের পিছনে ২টি ময়ূরের ভাস্কর নির্মাণ করেন। তাই পরবর্তীকালে সিংহাসনটি এই প্রানীর নামেই পরিচিতি পায়।
সিংহাসনে ব্যবহৃত সোনা ও হীরে-জহরতের পরিমাণ জানলে যে কেও অবাক হতে বাধ্য। অনুমান করা হয় যে ১১৫০ কেজি সোনা এবং ২৩০ কেজি বিভিন্ন মহামূল্যের পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই রাজকীয় সিংহাসন। তিমুর রুবি এবং দুর্লভ কোহিনুরের মতো পাথরও এতে ব্যবহৃত হয়েছিল। ধারণা করা হয়, বিভিন্ন যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুঘল রাজকোষে জমা হওয়া নানান মূল্যবান ও দুর্লভ ধাতু দিয়ে এই সিংহাসন নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছিল। তাজমহলের মতো দুর-দুরান্ত থেকে সামগ্রী আনা হয়নি এই স্থাপত্যের নির্মাণের কাজে। সিংহাসন নির্মাণে ব্যবহৃত হয় ১১৬ টা পান্না, ১০৮ টা রুবি সহ আরও অনেক মহামূল্যে পাথর, আর এসবের অনেক গুলোই ছিল খুব দুর্লভ। সিংহাসনের সৌন্দর্যের বিশেষ কারণ হচ্ছে, এর পেছনের ময়ূর ২টির লেজ ছিল ছড়ানো।


কথিত আছে যে, সম্রাট শাহ জাহান নবী হযরত সোলায়মান (আ.) কে নিজের আদর্শ মানতেন। সোলায়মান (আ.) এর সুবিশাল সাম্রাজ্যে একটি অতি রাজকীয় সিংহাসন ছিল, যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল সম্রাট শাহ জাহান। একারণে সেও তার বিশাল সাম্রাজ্যে একটি রাজকীয় সিংহাসন নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন, যেটাতে বসে সে সাম্রাজ্য পরিচালনা করবেন। সম্রাট শাহ জাহান ১৬২৮ সালে যেদিন মুঘল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব পান, সেদিনই প্রথম ময়ূর সিংহাসন ব্যবহৃত হয়। বাছাইকৃত স্বর্ণকার আর জহুরিদের প্রায় সাত বছর সময় লেগেছিল এই সিংহাসন বানাতে। সম্রাট শাহ জাহানের এমন আশা ছিল যে, এই সিংহাসন মুঘল সাম্রাজ্যের পরিচয় বহন করবে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সম্পদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ দুনিয়াকে ধারণা দিবে।
একবার ফরাসি একজন অলংকারিক, জিন ব্যাপ্টিস্ট টাভের্নিয়ার কে আমন্ত্রন জানায় শাহ জাহানপুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব। তিনি ভারতবর্ষ ভ্রমণে আসেন ১৬৬৫ সালে, সেসময়ে রাজপ্রসাদে গিয়ে ময়ূর সিংহাসন দেখে তার চক্ষু পুরোই চড়কগাছে।তার মতে,
” বিছানা আকৃতির ছিল সিংহাসনটি। এতে থাকা ৪টি পায়াই ছিল খাটি সোনার। সিংহাসনের উপরে ছিল ছাউনি, ছাউনিটি ছিল মহামূল্যের কাপড়ের, যা ধরে রাখার জন্যে মোট বারটি ছোট খুঁটি ছিল, এই খুঁটি বারটি ছিল সর্বাধিক মূল্যের, কারণ এই খুঁটি গুলোতে ছিল নানান দুর্লভ পাথর আর হীরে। ”
এই সিংহাসন মূলত থাকতো সম্রাট শাহ জাহানের তৈরি দিওয়ান-ই-খাসে, যা ব্যবহার করা হতো সম্রাটদের বাসস্থান হিসাবে। কিছু কিছু সময় দিওয়ান-ই-আমেও এটি আনা হতো। তাছাড়া যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা উৎসবে সম্রাট শাহ জাহান দিল্লী থেকে আগ্রা আসতো তখন, তার সাথে এই সিংহাসনও বহন করে আনতে হতো।
ময়ূর সিংহাসনের হাত-বদল:
যখন নাদের শাহ পারস্যের সিংহাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে, তার সবচেয়ে বড় চিন্তা হয়ে দাড়ায় আফগানিস্তানের ‘হোতাকি বাহিনী’। ইস্পাহান দখলের পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন ‘হোতাকি বাহিনী’ কে সম্পূর্ণ নির্মূল করবেন। নাদের শাহ তাদের সরানোর উদ্দেশ্যে আরো বেশি সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করেন, একারণে এক সময় তারা কান্দাহার পেরিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যে ঢুকে পরে। নাদের শাহ মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহকে শান্তিপূর্ন ভাবে হোতাকিদের হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন, কিন্তু সম্রাট তা প্রত্যাখ্যান করে।
এ কারণে নাদের শাহের ক্রোধ আরো বেড়ে যায় এবং এরপর সে বিরাট সৈন্যবল নিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যে আক্রমণ করেন। সম্রাট আকবর বা সম্রাট শাহ জাহানের সময় মুঘল সৈন্যবল যেমন শক্তিশালী ছিল, সম্রাট মুহাম্মদ শাহের সময় তা একদমই ছিল না। ফলে নাদের শাহের বিশাল সৈন্যের বিপক্ষে মুঘল সৈন্য টিকে থাকতে পারেনি। ফলে নাদের শাহ ১৭৩৯ সালের মার্চে দিল্লী দখল করে নেয়।
তবে নাদের শাহ বোকা ছিলেন না। মুঘল সাম্রাজ্যের মতো এতো বড় সাম্রাজ্যের দখল পেয়েও সে তার মূল সাম্রাজ্য ছেড়ে এই সাম্রাজ্যের সিংহাসনে এসে বসেননি। কারণ এতে তার মূল সাম্রাজ্য হয়ে পরতো আক্ষরিক এবং আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের দ্বারা তাকে সরিয়ে অন্য কারও সিংহাসন দখলের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যেত। তাই তিনি সম্রাট মুহাম্মদ শাহের সাথে সন্ধি করেন এবং তাকে তার রাজ্য ফেরত দেন। এই সন্ধির কারণে মুঘল সাম্রাজ্যের মূল্যবান সম্পদ-আদির একটা বড় অংশ নাদের শাহকে দিতে হয়। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ময়ূর সিংহাসনও। এভাবে মুঘলদের হাতছাড়া হয় অত্যন্ত মূল্যবান ও ঐতিহ্যসম্পন্ন এই সিংহাসন।
নাদের শাহ এর ক-বছর পর তার দেহরক্ষীর হাতে প্রাণ হারান এবং রাজ্যে অনেক অরাজকতা শুরু হয়। এরপর প্রাসাদ লুট হয়। অনেকের মতে লুটেরা ব্যক্তিরা প্রাসাদে ঢুকে ময়ূর সিংহাসন ভেঙে তার ভাঙা টুকরো গুলো চরা মূল্যে বেচে দেয়। আবার অনেকের ধারণা, নাদের শাহ নিজেই ভারতবর্ষ ছাড়ার পদে সিংহাসনটি ভেঙে টুকরো টুকরো করে, ইরানে রওনা হয়েছিলেন।আর লুটেরা ইরানের রাজপ্রাসাদ থেকে এই ভাঙা টুকরো লুট করেছিল। তবে পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্য অনুকরণ করে ইরানে ময়ুর সিংহাসন নির্মাণ করা হয়। যা এখন তেহরান যাদুঘরে সংরক্ষিত। ব্রিটেনের এক যাদুঘরে আসল সিংহাসনের একটা পায়া সংরক্ষণ করা আছে।


ময়ূর সিংহাসনটি ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের জৌলুশের পরিচয়। সময়ের সাথে সাথেই বদল আসে মুঘল সাম্রাজ্যে, এক সময়ের অতি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ইতিহাস থেকে নিজের জায়গা হারিয়ে ফেলতে থাকে। মুঘলদের গর্বের ময়ূর সিংহাসন দখল করে বিদেশী শক্তি। তবে ময়ূর সিংহাসন যতোই বিক্ষত হোক বা বিদেশী ক্ষমতার দ্বারা দখল হোক না কেন এই অতিনন্দিত কীর্তির জন্যে বিশ্ব ইতিহাস সর্বদা সম্রাট শাহ জাহানের নামই মনে রাখবে।