

The Silent Patient : থিও ফেবারের গল্প
পেশায় একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হলেন থিও ফেবার। না ঠিক সাইক্রিয়াটিস্ট নন ক্রিমিনাল সাইকোথেরাপিস্ট তিনি। তার অন্ধকারাচ্ছন্ন আর যন্ত্রনাদায়ক অতীত তাকে এই পেশায় নিয়ে এসেছে। তার অতীত ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক আর বেদনাদায়ক। তিনি এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী ক্যাথি আর তার থেরাপিস্ট তাকে সেই অতীত থেকে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলে। যদিও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি তিনি। এখনও নেশা জাতীয় দ্রব্যের সাহায্য নেন এবং উন্মাদের মতো ছুটে যান থেরাপিস্টের সাহায্যের জন্য। তবে পেশেন্ট নয় থেরাপিস্টের কাছে তিনি জানান বন্ধু পরিচয়ে। তার থেরাপিস্ট ও তার স্ত্রী ক্যাথি এখনো অবধি তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
শহরের এক নামকরা হলে একজন প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পী অ্যালিশিয়া বেরেনসনের আকাঁ একটি ছবি শোভা পাচ্ছে। অ্যালিসিয়া বর্তমানে একটি থেরাপি সেন্টারে বন্ধি আছে, যার নাম গ্রোভ। তবে তার অপরাধ কি? তার অপরাধ তিনি তার স্বামীকে হত্যা করেছিলেন এবং হত্যার পর তার আচরণ অস্বাভাবিকই ছিল। খুনের পর একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি তিনি। এই নির্মম নির্দয় মহিলাটির আঁকা ছবি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে এখানে আসার পর। সকলেই তাকে স্মরণ করছে ঘৃণা ভরে। অ্যালিসিয়ার তুলিতে ফুটে উঠত বিভিন্ন রকমের চিত্রকলা, যেগুলো হয়তো বাস্তবসম্মত কিন্তু অনেকটাই অদ্ভুত।
তার স্বামী গ্যাব্রিয়েল বেরেনসন ছিলেন একজন সুপরিচিত ফ্যাশন ফটোগ্রাফার। অ্যালিসিয়া তাকে খুন করে বেশ কয়েক বছর আগে। তবে খুনের এতবছর পরও তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হয়নি। তাঁর আঁকা একটি ছবির নাম ‘আলসেসিস্ট’। ছবিটি তার শেষ কাজ ছিল। তবে কে এই আলসেসিস্ট? খুনের সাথে কি তার সম্পর্ক? অ্যালিসিয়া থেরাপি সেন্টারে, পরিবারে যারা আছেন তাদের সাথে খুব বেশি যোগাযোগ নেই তার। খুনীর সাথে কেই বা যোগাযোগ রাখতে চাইবে?
অ্যালিসিয়া তাই থেরাপি সেন্টারে একা পড়ে আছে। মাঝে মাঝেই বেশ আক্রমণাত্মক আচরণ করেন তিনি। তাই তাকে সাবধানে রাখা হয়। অ্যালিসিয়া অনেকটা রোবটের মতো হয়ে গেছেন। তিনি হাসিও না আবার কাঁদেরও না। তবে তার কাছ থেকে একটি ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল। যে ডাইরিতে হয়তো তার নিরবতার কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
তার কেশ থিওরিকে এই ডাইরি অনেক আগ্রহী করে তোলে। সেই নীরবতার কারণ খুঁজতেই থিও ফেবার এসে যোগ দেন অ্যালিসিয়ার নীরবতার রহস্য উদ্ধারে। অনেকের চোখেই সেটা ভালো লাগছিলো না। তবে বেশ কষ্ট করেই অ্যালিসিয়ার চিকিৎসার দায়িত্ব পান থিও ফেবার।
এরপর থেকে একের পর এক ভয়ানক সত্য সামনে থাকে। থিও ফেবার জেনে অবাক হন যে, তাদের ছোটোবেলায় ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই একইরকম। তাদের দুজনেই তাদের বাবাকে ঘৃণা করতেন এবং বাবার কারণেই তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেন কেউ চাইছেনা অ্যালিশিয়া চিকিৎসার দায়িত্ব থিও ফেবার পাক? কি এমন কারণ?
পাঠকেরাও থিও ফেবার এর সাথেই ভয়ঙ্কর সব রহস্যের সামনে পরতে থাকে। রহস্যের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যেতে থাকে সবাই। স্বামীকে খুন করার পেছনে অ্যালেসিয়ার কারণটা কি ছিল? তার কথা না বলার কারন টাই বা কি? আর সেই ছবির রহস্য? সেটাই বা কি?
বইটির নাম ‘দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট’ একেবারেই সার্থক মনে হচ্ছে। চরিত্রে অ্যালিসিয়ার নীরবতা যেন এই বইয়ের কাহানীর মূল চালিকাশক্তি। কাহিনী সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে লেখক সম্পূর্ণ সার্থক হয়েছেন। প্রতিটি চরিত্রকেই দিয়েছেন প্রয়োজনীয় জায়গা। তবে কেন যেন মনে হয় ক্যাথির আরেকটু সময় এই কাহিনীতে থাকা ভাল ছিল।
গ্যাব্রিয়েল চরিত্রটি ছিল বেশ রহস্যময়। এ চরিত্র সম্পর্কে লেখক অতিরিক্ত বিস্তারিত বইতে উল্লেখ করেননি। তবে খুব যে কম উল্লেখ ছিল তাও নয়। আমার ধারণা সবারই থিও ফেবারকে পছন্দ হবে। থিও ফেবার নিজের অতীতের কষ্ট থেকে বের হতে পেরেছিলেন, বলেই তিনি ছিলেন একজন সফল সাইকোথেরাপিস্ট।
আসলে কৈশরে বা ছোটবেলায় অনেককেই ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবে বাইরের দেশে অনেক থেরাপির সুযোগ আছে। যা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। আজ ২০২১ সালে এসেও এদেশের মানুষ থেরাপির নাম শুনে নাক সিঁটকে বলবে “পাগল হয়ে গেছে”।
অ্যালিসিয়ার চরিত্রটা আসলেই দুর্দান্ত। চরিত্রটাকে শুরুর দিকে দুর্বল মনে হলেও আস্তে আস্তে তার শক্তিশালী রুপ ফুটে উঠতে থাকে। তার জীবনে মূলত অতীত বেশ প্রভাব ফেলেছিল। এটা গল্পের বই হলেও পড়তে পড়তে মনে হয় যেন আশেপাশের বাস্তব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমরা পড়ছি বইয়ের পাতায়। এলিফ, তানিয়া, ম্যাক্স ইন্দিরা এছাড়াও আশেপাশের প্রায় প্রতিটি চরিত্রই নিজেদেরকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে নিজেদের অবস্থানে। সবার জায়গায় ছিল নির্দিষ্ট আর সবাই নিজের ভূমিকা তুলে ধরতে পেরেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সময়মতো।
গ্রোভের প্রধান ছিল মূল চরিত্রের বাইরে ভালো লাগার মত একটি চরিত্র। গ্রোভের অংশটুকু পড়তে গেলে মনে হবে আপনি নিজেই হয়তো কোন থেরাপি সেন্টারে বসে আছেন। মনে প্রশ্ন জাগবে থেরাপি সেন্টার গুলো আসলেই কি এমন? নাকি অন্যরকম?
বইয়ের বেশকিছু কালের কথা উল্লেখ আছে। অতীত,বর্তমান, কখনো ছোটবেলা, কখনো বা অনেক আগের কিছু ঘটনা। আপনি যদি খুব সাবধানে না পড়েন তাহলে হয়তো গুলিয়ে ফেলতে পারেন। কারণ অ্যালিসিয়া ও থিও ফেবার প্রায় একই বয়সে আত্মহননের চেষ্টা করেন। তবে তাদের পরবর্তী জীবনের অংশগুলো অন্যরকম। এছাড়াও থিও ফেবার ঠিক কোন সময় থেরাপি নেওয়া শুরু করেছিলেন এবং কোন সময় অ্যালিসিয়ার ডায়েরি লেখা হয় এসব হিসাব বেশ গোলমেলে।
লেখক বেশ কিছু জায়গায় তারিখ উল্লেখ করেছেন তবে সালের কোন উল্লেখ নেই। যা কারণে তালগোল পাকিয়ে যায়।
গল্পের শুরু লেখক বেশ সুন্দরভাবে করেছিলেন। প্রত্যেকটা প্লট, টুইস্ট ঠিক জায়গা মতই দিয়েছেন। উপন্যাসটি বেশ কয়েকটা খন্ডে বিভক্ত করা আছে। একটার চেয়ে অন্য টা আলাদা। তবে সবগুলো একসাথে সংযুক্ত। প্রতিটা খন্ডের প্রারম্ভেই খুব সুন্দর সুন্দর কিছু কথা আছে যা বইয়ের সৌন্দর্য অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে।
পড়ার সময় অ্যালিসিয়ার আতঙ্ক আপনাকেও আতঙ্কিত করবে। থিও ফেবার এর সঙ্গে হয়ত মাতাল হবেন না কিন্তু তার মানসিক যন্ত্রণা আপনি অনুভব করবেন অবশ্যই। ক্যাথির সাথে সাথে আপনি হয়তো ভালবাসতেও শিখে যাতে পারেন।
উপন্যাসে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর গল্পের বাঁক আছে। যেটা উপন্যাসকে অন্য অনেক উপন্যাসের থেকে মর্যাদায় উপরে তুলে দিয়েছে। তাই থ্রিলারপ্রেমীরা এই বইকে ভালোনাবেসে বাধ্য। এবং খুব কম মানুষই এই কাহিনীর রহস্যের শুরু এবং শেষ ভাবতে পারবেন। কারণ লেখক বইতে যে সুন্দর সুন্দর চমক গুলো পাঠকের জন্য রেখেছেন তা বলে দিলে চমক আর থাকবে না তাই চমকাতে হলে বইটি পড়তে হবে আপনাকে নিজেই।
এবার আসা যাক এর অনুবাদ দিকে। ‘দ্য সাইলেন্ট পেশেন্টের’ প্রায় 3 থেকে ৩ টি অনুবাদ রয়েছে। তবে ভূমিপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত অনুবাদে বেশ কিছু ভুল আছে। অনুবাদকের নাম শোভন নবী।এ অনুবাদটি বেশ সাবলীল হয়েছে। তবে কিছু কিছু জায়গায় অনুবাদ আক্ষরিক মনে হচ্ছে। তাছাড়া বেশ কিছু বানানও ভুল আছে। তবে এসব বাদ দিলে অনুবাদটি পড়লে আসল উপন্যাসের স্বাদ অনেকাংশেই পাওয়া সম্ভব।
‘দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট’ বইটি পড়ে আপনি নীরব হয়ে যাবেন কিনা বলতে পারব না। কিন্তু আপনার মস্তিষ্কের ক্ষুধা এই বই অবশ্যই মেটাতে সার্থক হবে। যদি চমকাতে চান তবে এই বই আপনার তৃষ্ণা মেটাতে দারুন পারদর্শিতার প্রমাণ দেবে।